সেথায় পুঁতবে তারা কুঁড়ি

WhatsOddNWhatsNod
6 min readNov 20, 2023

--

“উড়ো চিঠি” দেখে আসার পর থেকে সেই যে একটা আনচান ভাব সেটা যেন যেতেই চাইছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, বেমালুম এরকম ভাল কাজ হয়ে যাবে আর আমি স্রেফ ফেবুর বাইরে বলে এসব জানতেই পারব না? আর তার থেকেও সাংঘাতিক একটা শিরশিরানি বা আজকের যুগের কথায়, নিজেকেই নিজে “gaslight” করে ভাবতে থাকা, আচ্ছা এরা সত্যি এত্তো ভাল তো নাকি নির্ঘাত এও এক “one hit wonder”? “Hey there Delilah” বা অঞ্জনের সুযোগ বুঝে টুকে দেওয়া “Where do you go to my lovely”, এরাও কি এদের মতোই হবে শেষমেশ?

এইসব গুচ্ছের হিজিবিজি মাথায় নিয়ে তাই গেলাম “যুদ্ধ শেষে” দেখতে। ভাগ্যিস! নাটক শেষে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল এরা যে সত্যিই ভাল! আগের বারে ট্রামের খাঁচার মধ্যে যতটা করা যায় সেটাতেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, এবারে একটা উঠোনে ঢুকিয়ে এনে কয়েক ঘণ্টা ধরে এরা যা করল সেটা হয়তো আরো বার কয়েক দেখলে তবেই সাধ মিটবে।

সেই ট্রামের পাগলামি এখানেও। যেটুকু আছে সেটার পূর্ণ ব্যবহার চোখে পড়ার মত। পুরনো বাড়ির ভেতর দিয়ে অসংখ্য জাদুপথ ধরে নিমেষে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এক রকম teleport করে চরিত্রদের নিমেষে দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যাওয়া, বাড়ির কোনো আবসিকের রান্নাঘরে ফোড়ন দেওয়ার আওয়াজের সাথে আলো-আঁধার আর গানের সুর উঠোনের মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকদের শরীরের আশেপাশের ফাঁকা জায়গাগুলোতে এমন নকশিকাঁথার মত বুনে দেওয়া হল, একই সাথে বুঝি অনেকগুলো অনুগল্প চলছে, তবু যেন সবকটাই সেই একই তারে গিয়ে বাঁধা পড়ছে।

অভিনয়, সংলাপ আগের নাটকের মতোই সহজ এবং সাবলীল। কিছু ছোট্ট জায়গায় কিছু শব্দের ব্যবহার একটু কানে লাগলেও সবটা শুনে সেরকম কোনো সমস্যা হয় না।

বড়রা বলে থাকেন, আমাদের সময়ে নাকি কোনো সেরকম বড় ঘটনা নেই, যুদ্ধ নেই, আন্দোলন নেই, আমরা নাকি তাই এরকম নিস্পৃহ, একরকম উদাসীন। মৃণাল সেনের সেই যুগের কথা বলতে গিয়ে কিছু মাস আগে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন কীভাবে সেই যুগে একটা আশা ছিল, একটা স্পর্ধা ছিল, লোকে দিন পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখত, কিন্তু আস্তে আস্তে যেন সবারই মোহভঙ্গ হল। তাই কেও আর স্বপ্ন দেখে না।

“যুদ্ধ শেষে” দেখে মনে হল দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়েও যেন তারা সেই স্বপ্ন দেখতে আর আমাদের দেখাতে চায়। সেখানে বন্দুকের দুই প্রান্তের মানুষকেই তারা আগলে মায়া দিয়ে মুড়ে রাখে যত্নে, তাদের বুকে কান পেতে শোনে বেঁচে থাকার চাপান-উতোর। “হামিদ” চলচ্চিত্রের স্মৃতি উস্কে দিয়ে, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর বিশেষ করে সৈন্যদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়েও ছোট ছোট কোলাজে অনেক ধরনের যুদ্ধ, অনেক রকমের হিংসা জায়গা করে নেয়।

সব যুদ্ধ তো আর বোমা বারুদে হয় না, কিছু কিছু নিঃশব্দে এসে চলে যায়। সরকার যতই সেই হতাহতের সংখ্যা বলতে নারাজ থাকুক, কৃষক মৃত্যুও যে আমাদের উন্নতির আস্ফালনের এক collateral damage, “যুদ্ধ শেষে” তাদেরও ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে, অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগে আলো ফেলে সেই প্রদীপের নিচের দিকটাও একবার দেখিয়ে দেয়।

এতদিন যেটাকে সত্যি বলে জানা হয়েছে সেটা একটা বয়সের পর যদি উল্টে যায়? ছোটবেলা থেকেই বোকা দেশের হতভাগ্য মানুষগুলোকে দেখে বিরক্তিতে-রাগে-ঘেন্নায় মনে হত পালিয়ে যায় দূরে কোনো উন্নত দেশের চকচকে সভ্যতায়। কিছুটা বড় হওয়ার পরে আজ যখন বুঝতে পারি পৃথিবীর যাবতীয় দুর্দশার জন্য ওই পরিচ্ছন্ন উন্নত দেশের (অ)সভ্যতাই দায়ী, তারা সময়মত নোংরা হাত দিব্যি ধুয়ে নিয়ে সব বিভোৎসতার দায় থেকে মুক্ত হয়ে যায় প্রতিবার, তখন সেই বোকা মার খাওয়া মানুষগুলোকেই নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে।

আমরা যারা হিংসা দুর থেকে দেখে নিরাপদ দূরত্বে থাকার সুযোগ পেয়েছি, পরের প্রজন্মকে কিছুটা আহ্লাদে বড় করতে গিয়ে হিংসা বলে কিছু হয়না, পৃথিবীটা ঈশপের গল্পের সূত্রে চলে, ছোটদের অত প্রশ্ন করতে নেই, এইসব বলে আদতে মানুষ করে তুলতেই ভুলে যাই। কিন্তু সময় দেখিয়ে দিয়ে গেছে (এবং প্রতিবার দেখাতেই থাকবে), কোনো হিংসাই কোনোদিনই শিশুদের রেহাই করেনি। আজ যা গাজায় কাল তা আফগানিস্তান, পরশু সেটা মায়ানমার। ভিয়েতনামের রাস্তায় ছুটতে থাকা কিম ফুক আর আল শিফা হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি শিশুদের মুখগুলো যেন ঝাপসা হয়ে একই রকম মনে হয়।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে আসা শর্মী হোসেনের গান শোনার সুযোগ হয় কোলকাতায়। উনি ডিলানের গানটা নিয়ে সেটার বাংলা করতে গিয়ে এক জায়গায় গাইলেন —

কাকে দেখেছিস তুই আমার সন্তান,
কাকে চিনেছিস তুই আমার প্রাণের ধন -
আমি দেখেছি যুদ্ধে শিশুদের কোনো ঘর নেই
তারা পুড়ছে
আমি দেখেছি তারা মানুষ না
শুধু সংখ্যা হয়ে উড়ছে

যখন দেখি প্রথম বিশ্বের সভ্যতা হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু দেখেও যুদ্ধবিরতি চাইতে গিয়ে তাদের জিভ জড়িয়ে ফেলছে, যখন দেখি এক একটা সভ্যতা আপাদমস্তক বোমা বারুদের কারবারি হয়েও “বিশ্বশান্তি”, “গণতন্ত্র” আরো যা সব গালভরা জিনিস আছে, সেসবের দেবতা হয়ে উঁচু মন্দিরে ঠাঁই পেয়ে যায়, তখন সব মিথ্যে মনে হয়। তবু মানুষ টিকে যায় ম্যাজিকের মত। শরীরে-মনে কত কত কোটি মানুষ মেরে ফেলার পরেও যেন যুদ্ধের শেষে আবার নতুন করে শুরু হয় প্রতিবার। সেরকমই শেষ থেকে শুরু করার গল্প এই “যুদ্ধ শেষে”।

অবশ্য “যুদ্ধ শেষে” অনেক মিলে যাওয়ার গল্পও!

২০১৮। নাটকের নায়কের মত আমিও একা বোকা থেকে থেকে শেষে Slowly বলে একটা অ্যাপ থেকে চিঠি লেখা শুরু করলাম শহর-রাজ্য-দেশ-মহাদেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষকে। সেখানেও সেই একই শর্ত, ভুল করেও চেহারা, পরিচয়, ঠিকানা কিচ্ছুটি বলা যাবে না আর কোলকাতায় কোনো দিন একই বাসে দেখা হয়ে গেলেও না চেনার ভান। শুধু ইতির পরে ছোট্ট করে কিছু একটা ডাকনাম, ব্যাস, সেটুকু দিয়েই সবটা চেনা।

সেভাবেই সেই মেক্সিকোর মিরিয়ামের সাথে আলাপ। তার মানুষের ছবি তোলার শখ ছিল, বিশেষ করে আন্দোলনের মধ্যে থাকা মানুষের। সেবার ওর দেশে মহিলারা রাস্তায় নেমেছিল গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের জন্য। তার পরে চিঠি এসেছে কখনো সুদান, কখনো হাওড়া, কখনো দিল্লি। আর বাংলাদেশের সেই মেয়েটা যেবার সাঁতার থেকে ফিরে বিকেলে ছাদে সিগারেট খেতে খেতে চিঠি লেখার কথা বলেছিল আর ওর চিঠি পড়ে নরওয়েজিয়ান উডে মিডোরির ছাদে উঠে দূরে কোনো বাড়িতে আগুন লেগে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখার কথা মনে হয়েছিল? এবার উঠোনের অন্ধকারে সেই পুরোনো সব কিছু, দুজনের চিঠির গল্প শুনতে শুনতে, ফিরে এসে ধাক্কা মারছিল বেশ।

আর মিলের মধ্যে নায়কের মত আমারও যে এই শহরে একটা ম্যাজিক রাস্তা ছিল! সল্টলেক স্টেডিয়ামের কাছে সেই স্বপ্নের দেশ, সেখানে বিকেল হলে রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে মোমের মত গলে গলে পড়ত। আর কম যানবাহন চলাচল করত বলে সেই একটা রাস্তা, একটা আইল্যান্ড থেকে শুরু হয়ে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে পরের আইল্যান্ড অব্দি, সেখানে রোজ বিকেল হলেই ম্যাজিক হত!

অবশ্য সেদিন ১৬ বি, হাজরা রোডের বাড়িতে যে ম্যাজিক হল, সেটা বিকেলের আলো নিভে যাওয়ার পরেই। সেই আবেশের জন্য আলো নিয়ে অক্লান্ত ছুটে যাওয়া মানুষ-জোনাকিদের যেরকম কৃতিত্ব, তাদের মতোই অন্ধকারে মিশে যাওয়া গানের দলকে নিয়ে আলাদা করে কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন।

যন্ত্রানুসঙ্গের সাথে গানের ব্যবহারও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত। নাটকের নানা মুহূর্তের সাথে সেই গানের দল এত স্বাভাবিক ভাবে নিজেরা মিলেমিশে যায়, নাটক কিছুটা এগোনোর পর থেকে আলাদা করে আর তাদের টের পাওয়া যায়নি। প্রচলিত গানের ফাঁকে “ডাকবাক্সের গান” এনে দিয়ে সেটাকে নিপুণভাবে নাটকের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য আলাদা ভালোবাসা রইল। গানের দল হিসেবেও স্বাধীনভাবে “সম্পর্ক” বেশ সুন্দর গানের অনুষ্ঠান শহরের মানুষকে উপহার দিতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। সেই গান শুনতে পাওয়ার সুযোগ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

--

--

WhatsOddNWhatsNod

A bi-lingual blog for the rare nods in the sea of overwhelming odds.