ফুলস্টপ

WhatsOddNWhatsNod
9 min readMay 10, 2021

আজ দ্বিতীয় দিন। সকাল দশটা পঞ্চান্ন। কাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। গরমটা আর নেই। তাও মন ঠিক করতে পারছি না।

বহু বছর হয়ে গেল কাছের কেও মারা যায়নি। আক্ষেপ নেই কিন্তু হঠাৎ কাল দুপুর নাগাদ খবরটি হুড়মুড় করে এসে ঢুকল। সেই দিদি মারা গেছে। কোভিড এ। ঠিক পরশুদিনই জানতে পেরেছিলাম যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আর আজকেই সব শেষ। “সব” শেষ কথাটা কি স্বভাবের দোষেই বলে ফেলি আমরা কেও মারা যাওয়ার পর? সিনেমা টিভি দেখে দেখেই কি এই ধারণা মাথায় এসেছে নাকি এরকম কিছু হলে ভাষায় বোঝানোর ক্ষমতা হারায়। কই সব তো শেষ হয়নি! আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। জানলা দিয়ে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে যা মে মাসের গরমের মধ্যেও একটা ছেঁকা লাগার মত। ওই তো রান্নাঘর থেকে আওয়াজ পাচ্ছি কিছু ভাজা হচ্ছে। এই তো হালকা খিদে পাচ্ছে। তার মানে এটাই বাস্তব। বেঁচে থাকাটা।

কী ভাবে কেও মারা যাচ্ছে সেটাও অবশ্য একটা ব্যাপার। জন্মানোর সময় যেরকম সব স্লো মোশনে হয়। এই স্ক্যানে বেরোলো টিকটিকি। পরের স্ক্যানে সেই টিকটিকির মাথা মোটা। আস্তে আস্তে হাত পা গজাতে গজাতে একদম পেটের বাইরে। মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সেই সুযোগ পায়না। বহুদিন রোগে ভুগে চলে যাওয়া এক ব্যাপার। মানসিক ভাবে একটা প্রস্তুতি কি দরকারি? (ইশ কী বাজে লোক মাইরি, মানুষ মরবে সেটাও ওর বলে দেওয়া ঢঙে মরতে হবে?) আর এমনিও সময়ের হুহু হাওয়ায় কি সব মরে যাওয়া শেষে গিয়ে এক হয়ে যায়? বহুদিন পরে কি সব আসলে সেই একই না থাকা হয়ে যায়?

জানি না। এই তো পরশু অব্দি লোকটা ছিল। তেমন কিছুই বয়স নয়। তিরিশের ঘরে। ব্যাস দুদিন পর আর নেই? এরকম ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে গেল। হাতে রিমোট নিয়ে হাজার টিপলেও আগে যাওয়া যাচ্ছে না। চোখ বুঁজে চিন্তা করলেও এক বুক দুঃখের মধ্যে কিছুই মনে পড়ছে না। তার ওপর এমন অবস্থা যে শেষে একবার দেখতেও পেলাম না যে শেষ দেখাটা ফ্রিজ শটে তুলে রাখব মনের ভেতর। নিয়ম নেই যাওয়ার। মনে পড়ছে তার দাদু মারা যাওয়ার সময় দাদুর শখের পাউডারের এক পোঁচ দাদুকে মাখিয়ে দিয়ে তারপর তার মা ছেড়েছিল। কোরোনার আগেও আপনজন থেকে এক ধাপ নেমে একটা মানুষকে “বডি” হয়ে যেতে শুনেছি। কিন্তু এখন যেন আরো কয়েক ধাপ নেমে একটা মানুষ থেকে সোজা সমাজের ভয়ানক আবর্জনা হয়ে বস্তায় বেঁধে পুড়িয়ে দেওয়ার কথা শুনছি।

তাহলে কী ভাবে মনে রাখব তাকে?

সে কি আদেও কোনোদিন ছিল? খালি মনে পড়ছে খুব হেঁড়ে গলায় ডাক পারতো। ইয়ার্কি মেরে নিজেই জোরে হাসতে হাসতে হাত পা ছুঁড়ত। সেই হাসির মধ্যে কিছু ঘুঁষি আর চর গায়ে পিঠে এসে পড়ে ব্যাথা হয়ে যেত। আর বিশাল পাওয়ার এর চশমা পড়ত। চোখ দুটো এতো ছোট দেখাতো… আর কিছু? ওই সারা জীবন খালি পড়াশোনা। এই ডিগ্রি শেষ হলে আরেক ডিগ্রি। শেষে এই কিছুদিন আগেই চাকরি আর একদম নিজের জন্য নতুন ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাট এ আমার যাওয়া হয়নি তার আগেই এই কোরোনা। কিরকম অবাস্তব লাগছে। মনে হচ্ছে ওটা কোন সিনেমা চলছিল। শেষ হলে ব্যাস নেই কিছু। যতক্ষণ চলছিল ততক্ষণ চরিত্রগুলোর সাথে আলাপ। কাছ থেকে দেখা। তারপর আর নেই। নিজের জীবনে ফিরে আসা। কলম্বাস সিনেমাটা দেখার পর কিছুক্ষনের জন্য মনে হয়েছিল ওই মেয়েটাকে চিনি। ওর মাথার ভেতরেরটুকু জানি। ওই জায়গায় কোনোদিন না গিয়েও যেন থেকে এসেছি।

এই নিয়ে দ্বিতীয় দিন।

শুধুই মনে হচ্ছে কতকিছুই তো স্বপ্নে দেখি। হয়তো এটাও স্বপ্নে। আসলে সে বেঁচে আছে। আমি হয়তো পুরোটাই ভেবে নিয়েছিলাম। সাড়ে বারোটা নাগাদ মা যখন ঘরে ডাকতে এসেছিল সেটা নিশ্চয় চান করতে যাওয়ার তাগাদা দেওয়ার জন্যই। চোখ বড় বড় করে তো অনেক বকা বকি এমনিতেও করে। খালি মনে হচ্ছে কিচ্ছু হয়নি। এই কোরোনা কেটে যাবে। ব্যাস যে যে লোকগুলো মারা গেছে সব ফিরে আসবে। নাটকের মত সবাই স্টেজের সামনে এসে ঝুঁকে ব্রহ্মতালু দেখাবে।

এরকম অবস্থা অবিশ্য আমার খুব হয়। অন্য একটা ব্যাপারে।

বহু বছর ধরে এমনকি এখনও আমার মনে হতে থাকে সব মিথ্যে। আসলে আজ সকালে উঠে ভাববো সব আগের মতোই আছে। আবার সেই ফোন করা চালু হবে। নাহলে কী ভাবে মেনে নেব যে যাকে এতগুলো বছর ধরে চিনি সে হঠাৎ করে আর থাকবে না? যে এতদিন এত ভালো ভালো বলে এসেছে সেই আবার কান চুলকোনোর আরামে এক চোখ বন্ধ করে বছর বছর আগের পুরোনো ভুলগুলো খুঁচিয়ে বের করে এনে মনে করিয়ে দেবে?

ভুল করে চিঠি পড়ে ফেলেছিলাম পুরোনো একটা। না না হাতের সামনে পেয়ে ইচ্ছে করেই, বেশ একটা অন্য কারো চিঠি পড়ে ফেলার উত্তেজনা নিয়ে। এই কিছুদিন আগেই। চিঠিটা অবশ্য এগারো বছর আগের। সেখানে লেখা পড়ে মনে হতে লাগল আরে আরে একেই তো চিনি। হঠাৎ মাঝখান থেকে কী হয়ে গেল। না না কিছু হয়নি। মুনের ভুল হইসে। ব্যাস।

তার পরের ফর্মুলা জানা। আবার বেশ কিছুদিন হাত সুড়সুড় করবে একটু কথা বলতে। সামলাতে না পেরে যোগাযোগ। আবার সেই ফসিল টেনে টেনে বের করা ইতিহাস পাঠ। সব শুনে আবার মন খারাপ। ইশ, কেন কথা বলতে গেলাম সূচক ন্যাকামি। এই একই ফর্মুলায় ঘুরপাক। ঘুরপাক।

এটা কি আত্মীয়র মৃত্যু শোকের থেকে কিছু কম? যে আত্মীয়র শরীর টা বেঁচে আছে। কিন্তু তার আত্মাটা মানে মানুষটা যা আমার ধারণার, সেটা তো আর নেই। অন্য কেও এসে থাকে এখন ওখানে। সে অন্য ভাবে হাসে। অন্য জিনিসে মজা পায়। আমি যার সাথে কথা বলতে চাইছি সে কিন্তু সেই মানুষটা নয়। কাজেই রং নাম্বার এর মত কেস।

ইই ম্যা, দ্যাখ দ্যাখ লো, ফেলে আসা পেরেম এর হাঁকু পাঁকু করসে এবার। ছ্যাঃ ছ্যাঃ।

এই পুরোটাই বোধয় সেই ফর্মুলা মেনে। দুঃখের অনেক ধাপ থাকে। ধাপে ধাপে এগোয়। তার একদম প্রথম হল ডিনায়াল। মানে এই আমি যেটা নিয়ে বলে গেলাম। এগুলো নাকি হয়নি। সিনেমা নাটক কত কিছু বললাম। সত্যিটার থেকে আপাদমস্তক চাদরমুড়ি হয়ে থাকলে সত্যিটা পাল্টে যায় না। পর পর অনেক ধাপ। রাগ হবে। শেষে গিয়ে মেনে নেওয়া। এই ভাবে কিছুদিন যাবে দিয়ে আবার শুরু থেকে শুরু। ডিনায়াল।

না। তাও একটা তফাৎ আছে। বিরাট তফাৎ। আগে থেকে বুঝিনি কিন্তু ঘটনা হওয়ার পর বুঝেছি। কবি বলেছেন “বয়সের সাথে সাথে কমে যায় চোখের জল”। সেই সূত্রে আমার কখনো প্রেমের কারণে দুম দাম কান্না পায়নি। খুব দুঃখ, বুক ভারী, বিছানা থেকে শরীর তোলা যাচ্ছে না এই সব হয়েছে। কিন্তু সেভাবে কান্নাকাটি হয়নি। আবার উল্টোদিকে চেনা অচেনা মানুষের মারা যাওয়ার চিন্তায় হাউ মাউ। অরুন্ধতী রায়ের লেখা পড়ে হাউ, খবর পড়ে মাউ, এইসব হয়েই থাকে।

একবার হয়েছে কী, কোন এক সকাল বেলায়, তখন রোজ খবর কাগজে চোখ ঘষার একটা অভ্যেস ছিল। নিয়ে বসেছি খবরের কাগজ। পাতা ওল্টাতে গিয়ে হঠাৎ একটা খবর পরে সব থেমে গেল।

ঠিক এই এই কিছু সেকেন্ডের স্তব্ধতা। এটা কাল দিদির খবর শোনার পর হয়েছিল। এটা ইরফান খানের খবর জেনেও হয়েছিল। ওই ক্ষনিকের একদম সময় থেমে যাওয়ার মত ব্যাপার। যেন হাওয়া শুষে নিয়েছে কেও। একদম কোনো আওয়াজ নেই। রাস্তায় এক্সিডেন্ট এ ঠিক এরকম একটা হয়। ধাক্কার আওয়াজ। তারপর একদম চুপ। মানুষ বুঝে উঠতে পারে না কি হয়ে গেল। তারপর আবার হৈ হৈ।

সেদিন খবরের কাগজে কোহেন মরে যাওয়ার খবর ছিল। আনন্দবাজারে তার ছবি ছেপেছে দেখে একটু অবাক হয়ে সেদিকে দেখতে গিয়েই হেডলাইনে চোখ পড়ে গেল। কোহেন আমার কোন দাদু জেঠু পিসে হয়? কেও তো হয়না। কিন্তু না হয়েও তো অনেক কিছু হয়। যে কথা গুলো ভেবে ভেবে যৌবন টলমল, সেগুলো সহজে লিখে গেয়ে তো ওই লোকটাই পেরেছিল। তার মাথার ভেতরের লোকটাকে কিছুটা তো চিনেছি। অতটা আমার দাদু জেঠুদেরও কোনোদিন চিনিনি। সেদিন খবর পরে আবার সেই ঢেউয়ের মত কান্না। কেন!!! পাআগোওওওল নাকি? জানি না! কিন্তু কোথাও একটা ভয়। একটা মন খারাপ। মনে হচ্ছে সেই “সব” শেষ হয়ে গেল। আমার ইচ্ছে ছিল কোন একদিন সামনে থেকে দেখে আসব। গান শুনব।

আরে বাবা তাতে হবেটা কী আলাদা করে? যদি প্রচলিত ধারণার মত দূর থেকেই ভাল আর কাছে গেলেই বাঁশঝার হয়? যদি কবির সুমনের মত ঝোলায়? মানে তার জন্মদিনে তার প্রথম লাইভ শো দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা সে যেরকম খেয়াল গেয়ে আর বস্তাপচা খিস্তি করে সেই পুরোনো গল্প আর স্তন্যপানের গল্প করেই মাঠে মেরে দেয়? জানি না। বাস্তববাদী হওয়া সব সময় বুঝি ভাল না।

এখন মনে হয় এই যে কালকেও দিদির মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার ঘন্টা দুয়েক পর সেই থৈ থৈ ব্যাপার, এটা আসলে মানুষটার জন্য হচ্ছে না। এই দিদির সাথে বছরে খুব বেশি হলে তিন চারদিন দেখা হত। তাহলে? আমার মনে হয় এই মরে যেতে হবে, এটা মনে পড়ে গিয়েই যত কেলেঙ্কারি। মৃত্যু একটা অন্যই জিনিস। কারো ক্ষমতা নেই। ঝগড়া কর, দুর্নীতি কর, অপমান কর কোনোকিছুই তার সামনে টিকবে না। একটা হাঁচির মত হেই হেই হেই করে আসা আর নাক মোছার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। মাঝের সময়টা ঝড়ের মত চলে যাওয়া। তার মধ্যে এই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার চেষ্টা, হাজার মায়া সবটা ওই ঝড় আসবে না ভেবেই। আমি আবার বেরসিক তাই ভূত ভগবান ভবিষ্যৎ কিছুই মানি না। তাহলে আমি যাবটা কোথায়!! মনে আছে প্রথম প্রথম যখন বিশ্বাসী থেকে অজ্ঞেয়বাদী হয়ে শেষে নাস্তিক হলাম তখনও থেকে থেকে শববাহী গাড়ি পাশ দিয়ে গেলেই হাতটা সেই কপালে উঠে যেত যন্ত্রের মত। অনেক চেষ্টায় থামানো গেছে। কিন্তু আজও পাশ দিয়ে গেলে হাতটা বুকের কাছে যাব্বেই যাবে। হার্টবিটটা বুঝে নেবে আর মনে হবে নাঃ বেঁচে আছি।

এ এক অদ্ভুত সুইচ। একবার টিপে দিলে ব্যাস। আর অন অফ করার সুযোগ নেই। গাছ পুষি সেই কারণে। প্রাণী পুষলে ওই সুইচ আগলে পড়ে থাকা। যদিও গাছও তো একবার মরে গেলে সব শেষ।

ছোটোবেলায় মনে হত আহা যদি মানুষ প্রচুর প্রচুর বাঁচতে পারত তাহলে কী মজাই না হত! আরেকটু বড় হলাম। বুঝলাম না না তাহলে তো বাড়িতে বাড়িতে ঝামেলা। গাদাগাদি। কষাকষি। গ্যাদগ্যাদে ডানপন্থী ব্যাপার। তার চেয়ে নাহয় খুব জরুরি কারণে বাঁচা যাবে? মানে বাবা মা বা ছেলে পিলের এই সামনেই বোর্ড পরীক্ষা। এখন আমি মারা গেলে কে দেখবে ওদের। তাই শরীর থেঁতলে গেলে যাক, অন্য একটা শরীরে বেঁচে থাকাটা ট্রান্সফার করে দিলে ফাটাফাটি ব্যাপার। তারপরেই আবার মনে হল সব ব্যাপারই তো প্রয়োজন দিয়ে শুরু হয় আর শেষে লোভ অব্দি এসে থামে। তাই যা আছে তাই ঠিক। এই ফুড়ুৎ হওয়ার জন্যই বাঁচার দাম অনেক।

ওয়েস্টওয়ার্ল্ড এ এরকম ছিল। যান্ত্রিক মানুষগুলো রোজ রোজ মরে যায়। আবার পরে ফিরে আসে। শরীর সারিয়ে টারিয়ে আবার চকমকে হয়ে আসে। জানি না। নিজেকে যে মরতে হবে বা এই সামনের খিটখিটে লোকটা আর ওই যে মহিলা সকাল থেকে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে চান করা আর খাওয়া নিয়ে, সেও তো একদিন আর থাকবে না। কী হবে? জানি না।

কত কত মানুষ মরে যাচ্ছে রোজ কোরোনার জন্য। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় যে কোরোনার মধ্যে এতো এতো সভা করা শুধু নির্বাচনী প্রচারের জন্য কি ঠিক হল? উনি বলেন বাজে কথা। আমার মাস্কবিহীন পদযাত্রার জন্য কিস্যু হয়নি। হলে মহারাষ্ট্র বা দিল্লিতে কেন বাড়ছে। সেখানে তো কোনো নির্বাচন নেই। গোপাল ভাঁড় এই ভাড়ামি করছে সব জেনে বুঝেই। আমি ধাঁ করে ট্রাক চালিয়ে ডজন লোক মেরে দিলাম পিষে। আমায় বললেই বলে দেব, হুঁ সারা দেশে কত কত লোক ট্রাকে পিষে মরছে এক দিনে, আমি তো সব জায়গায় ট্রাক চালিয়ে বেড়িয়েছি? তাহলে কেন মরছে?

এর মধ্যে যা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে যেহেতু রাজ্য কেন্দ্র দুজনেই নির্বাচনে মেতে ছিল, কেও আগাম অর্ডার দিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি ভ্যাকসিন। প্রচারের সময়ই যত ফ্রীতে দেবে বলেই খালাস।

হাতিবাগানের দর দাম রাষ্ট্রীয় লেভেলে নিয়ে চলে গেছে ভ্যাকসিন নিয়ে। পয়সা তু দিবি না মু দেব সেই নিয়েই চলছে। চলা উচিত অবশ্যই। দাঁত কেলিয়ে #Largest vaccination drive লিখে তার পাশে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ততক্ষণই মানায় যতক্ষণ বাস্তবে তুমি হাত গুটিয়ে নেই। গোটা গোটা মাস জুড়ে একটা রাজ্যের নির্বাচনী মঞ্চ থেকে টোন টিটকিরি করে বেড়ালেই তো হয়ে যায় না সব। মুরদ যখন নেই দেশের নেতা হয়ে এইরকম জরুরী অবস্থাতেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তখন ওই নির্লজ্জের হাসি হাসি মুখের ছবি কোরোনার সবকিছু থেকে সরিয়ে নেওয়ার সাহসটুকু থাকা উচিত ছিল। ধুর ধুর কাকে বলছি।

মানুষ বলে আমরা নাকি ফ্যাসিস্ট শাসনের মধ্যে আছি। নাকি নয়, সত্যি থাকি। কিন্তু ফ্যাসিস্টটা ওই মেছো বেড়ালটা নয়। এই বেড়াল ধরি মাছ আর করণ থাপর প্রশ্ন করলেই গিলি পানি। ট্রাম্প বলসেনারো পুতিন যত হাড় জ্বালানো কথাই বলুক না কেন, তারা তাদের দেশের তাবর তাবর সাংবাদিকের প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাদেরটা তো সেটুকুই পারে না, সে অবার ফ্যাসিস্ট হবে? আগে নেতা হওয়ার সাহস রাখুক তারপর।

তাহলে মানে ইয়ে, ফ্যাসিস্ট রাজত্বে নেই আমরা?

আছি। এখানে ফ্যাস্টিস্ট একটা মানুষ নয়, একটা চিন্তাধারা। সেই চিন্তাধারা কোরোনা সংক্রমণের থেকেও সাংঘাতিক। মানুষকে জিইয়ে রেখে তাদের ঘিলু খেয়ে নিচ্ছে। সাধারণ নাগরিক বদলে যাচ্ছে অসাধারণ স্তাবকে। এতো কিছু দেখেও বলতে পারছে, আহা তোরা না বড্ড নিন্দুক। সব দোষ ওই সোনটামনাকে দিলে হবে? দেশের দায়িত্ত্ব কি ওর? শুধু ভালো কিছু হলে তার ক্রেডিট সুদে আসলে পাবে, পাওয়াই উচিত। খারাপ হলে তো সেটা গান্ডু জনগণের দোষ। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীরও কি কোন দোষ আছে? ও তো চেষ্টা করেছিল রামদেবের কোরোনিলের প্রচারে নিজে গিয়ে সবাইকে সারিয়ে তোলার। ভ্যাকসিন নিয়ে খামোখা খ্যাক খ্যাক করিস তোরা। যা হবার তাই হবে। আমার কপালে যদি থাকে, হবে কোরোনা। কপালে মাস্ক পড়ে নেব!

ভেসে গেছিলাম। রাগে নয়। দুঃখেও নয়। অপমানে। দেশের মানুষ অক্সিজেনের মত মামুলি জিনিস না পেয়ে যখন মারা যাচ্ছে, যেখানে কালোবাজারির চোটে মানুষ জেরবার, যেখানে রাষ্ট্র বলছে এতো টাকা নেই ভ্যাকসিন দেওয়ার, সেখানে কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিলাসবহুল রাজমহল বানানোটা আমাদের অপমান বৈ আর কিছু নয়।

তবে এসব নিয়ে লিখে কী এমন হবে। কেও পড়বে না। পড়লেও কিছু হবে না।

এই সব জানি।

তাই এবার ফিরে এসেছি। ফুলস্টপে। মরে যাওয়ার চিন্তায়।

আচ্ছা, একদম শখ যেগুলো করা হল না সেগুলোর জন্য আফসোস হয় শেষ জেগে থাকার সময়ে? শেষ আধঘন্টায়?

নাকি সেটা ঘুমের মত। দুপ। লোড শেডিং।

আর খুব সাবধানে বাড়ির এদিক ওদিকে লুকিয়ে রাখা গোপন জিনিসগুলো মারা যাওয়ার পর কেও ঘাঁটতে গিয়ে খুঁজে পেয়ে যাবে সেই দুশ্চিন্তা? অপুর পুঁতির মালার থেকেও কঠিন জিনিস যেগুলো।

সেই যে বত্রিশটা জিনিস শেখার শখ ছিল?

উফফ ইউরোপে ঘোরার প্ল্যানগুলো? দেশের ভেতরেই সেই অমুক অমুক জায়গাগুলো যা প্রত্যেকবার ভাবলেও শেষমেশ সেই ঘুরে গিয়ে সিকিম বা দার্জিলিং হয়ে যায়?

আহা শেষ ঝগড়ার সময় ওভাবে না বললেই হত, বেচারী দুঃখ পেয়ে থাকতে পারে ভেবে একবার মিটমাট করতে ইচ্ছে করে না?

আমি আইসা ভীতু, জ্বরে পড়লেই মনে হয় মরে যাব আর এই উপরের কথাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে। তাও শেষে কী অদ্ভুত ভাবে বার বার বেঁচে ফিরি নিজেকেই চমকে দিয়ে!

কিন্তু একটা জিনিস জানি।

এইবার যদি জ্বরে পড়ি, হয়তো আর ফিরব না।

পুঃ এটা লেখার কিছু সপ্তাহের মধ্যে আরো কিছু চেনা মানুষ মারা যায়। একজন অবশ্য কোভিড এ নয়। তার পর যা হয় আর কি, ওয়াটসাপে গেলে তাদের ফেলে রাখা ছবি, ফোন নম্বর আর নিজের জন্যই নিজের লেখা অবিচুয়ারি মিলে এক রকম ডিজিটাল কবরে পরিণত হয়েছে। গেলেই চোখে পড়ছে। ভাবছি তাদের কন্টাক্ট ডিলিট করে দেব।

--

--

WhatsOddNWhatsNod

A bi-lingual blog for the rare nods in the sea of overwhelming odds.